ওয়ার্ল্ড হিয়ারিং ডে-২০২৩

আগামী তেসরা মার্চ আসছে ‘বিশ্ব শুনানি দিবস’। আগামী তেসরা মার্চ আসছে ‘বিশ্ব শুনানি দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে – ‘সকলের জন্য কান ও শুনানির যত্ন’। আসুন এই স্লোগানকে আমরা বাস্তবে রূপদান করি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার নিমিত্তে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কান ও শুনানির যত্ন বিষয়টি সংযুক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব প্রদান করেন। এ সংলগ্ন মূল কথাগুলো নিন্মরুপ:

  • ১। কান ও শুনানির সমস্যাগুলো বর্তমানে সবচেয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে।
  • ২। ৬০ ভাগের বেশী সমস্যা প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পর্যায়ে নির্ণয় করা সম্ভব।
  • ৩। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় কান ও শুনানির যত্ন বিষয়টি সংযুক্ত করতে হলে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতার অর্জনের দিকে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
  • ৪। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় এই বিষয়টি সংযুক্ত হলে মানুষ ও রাষ্ট্রের অনেক উপকার হবে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উদ্দেশ্য পূরণে ভূমিকা রাখবে।

এই দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কান ও শুনানির যত্নে একটি নতুন প্রশিক্ষণ গাইডলাইন প্রদান করবে। কিছু উদ্দেশ্য সামনে রেখে এই দিবসটি আমরা পালন করবো। যেমনঃ

  • ১। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় কান ও শুনানির যত্ন বিষয়টি সংযুক্ত করার নিমিত্তে সরকার ও সুশীল সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ।
  • ২। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় সরকারকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচী প্রদানে উৎসাহ প্রদান করা।
  • ৩। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় কানের অসুখ ও বধিরতা সম্পর্কে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী এবং চিকিৎসক বৃন্দকে সচেতন করা।
  • ৪। কান ও শুনানির যত্ন সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করা।

এই দিবস উপলক্ষে আসুন জেনে নিই কান, কানের যত্ন ও কেন আমরা কানে কম শুনি এ বিষয়গুলো।

কান নিয়ে কিছু কথা:

কান শুধুই শুনতে সাহায্য করে না, শরীরের ভারসাম্যও বজায় রাখতে সাহায্য করে।

প্রাকৃতিক-ভাবেই কানের ময়লা বেরিয়ে আসে। কানের ময়লা সাধারণত বিশেষ কারণ ছাড়া আলাদাভাবে পরিষ্কার করার প্রয়োজন পড়ে না। প্রয়োজন হলে কান পরিষ্কারের জন্য ডাক্তারের কাছেই যাওয়া উচিত। কটন বাড ব্যবহার সাময়িক আরাম দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্ভাবনাই প্রবল। কানের ভিতরে চামড়ার নানা সমস্যা ও ব্যথার কারণও কটন বাড। এছাড়া কাঠি, তেল, পিন, ক্লিপ ব্যবহারের ফলে কানে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। বহুদিন ধরে এগুলো ব্যবহার করলে ছত্রাক সংক্রমণও হতে পারে। অহেতুক কান খোঁচাখুঁচি বিপজ্জনক। অনেকসময় কটন বাডের তুলোর খানিকটা অংশ কানে থেকে গিয়ে বিপদ বাড়ায়।

কান চুলকানোর সাধারণ কারণ হলও খৈল, ছত্রাক সংক্রমণ, অ্যালার্জি, দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগ ও বহিঃ-কর্ণের সংক্রমণ।

কান ব্যথার সম্ভাব্য কারণ হলও কানের মধ্যে খৈল জমা হওয়া, কানে জীবাণুর সংক্রমণ হওয়া, মধ্য কর্ণে বা পর্দার পিছনে  পানি জমা হওয়া।

কান বন্ধ অনুভবের প্রধান কারণ হলও বহিঃ-কর্ণের খৈল জমা হওয়া অথবা কানের মধ্যে বাহিরে কোন বস্তুর (ফরেন বডি) প্রবেশ। কানের খৈল হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। খৈলের কারণে কান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে খৈল বা ফরেন বডি অপসারণ জরুরী। এছাড়া মধ্য কর্ণের সংক্রমণ বা পানি জমে থাকায় কান বন্ধ অনুভব হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

দীর্ঘ সময় এবং উচ্চ ভলিউমে গান শোনা শ্রবণ শক্তি কমিয়ে দেয়। হেড-ফোনে গান শোনার সময় বিরতি দিয়ে এবং ভলিউম কমিয়ে শোনা উচিত।

কানে ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ শব্দ হওয়াকে টিনটাস বলে। এটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কানে শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া লোকেরা কম শুনে থাকেন। কানে খৈল, জীবাণু সংক্রমণ, আঘাত, ক্যান্সার এবং অন্তঃকর্ণের সমস্যাতে কানে ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ শব্দ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট রোগের সঠিক চিকিৎসায় টিনিটাস ভালো হতে পারে।

নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ কানের জন্য ক্ষতিকর। এ সকল ঔষধ ব্যবহারে অন্তঃকর্ণের কিছু সংবেদনশীল অংশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ফলে শ্রবণ শক্তি হ্রাস পায়। যেমনঃ Gentamycin Streptomycin, Frusemide, Chloroquine এবং Asprine এ সকল ঔষধ অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত।

কেন আমরা কানে কম শুনি?

  • যেকোনো বয়সের মানুষ, একেবারে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সের ব্যক্তি শ্রুতির সমস্যায় ভুগতে পারেন। নীচে দশটি কাড়ন দেয়া হল:
  • বয়স জনিত পরিবর্তন – এটাকে সবচেয়ে বড় কারণ ধরা হয়। বয়স বাড়লে শারীরবৃত্তীয় অনেক পরিবর্তন হয়, তার মধ্যে শ্রবণশক্তি হ্রাস অন্যতম। অন্তঃকর্ণের সেন্সরই কোষ ( Hair cell) ক্ষতিগ্রস্ত বা ক্ষয়গ্রস্থ হয়। এক্ষেত্রে হিয়ারিং এইডের বিকল্প নেই।
  • শব্দ দূষণ – এটাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারন হিসেবে দেখা হয়।
  • এটাকে নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। গাড়ির হর্ন, কলকারখানার ভারী যন্ত্রাংশের শব্দ, মাইকের অসতর্ক উচ্চমাত্রার ব্যবহার, নির্মাণকাজ থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী তীব্র শব্দের উৎপত্তি হয়। পরিবেশের কোলাহল থেকেও মারাত্মক শব্দ দূষণের সৃষ্টি হতে পারে, যা আমাদের কানের শুনানি মারাত্মক ব্যহত করে।
  • ইনফেকশন, কান পাঁকা ও কানের ওয়াক্স – ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাংগাস সংক্রমণ হয়ে কানে ইনফেকশন হতে পারে। সাধারণত কটনবাড, কাঠি ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এছাড়া ময়লা পানিতে সাতার বা গোসল করা ও শরীরের অন্য কোন ইনফেকশন এর কারণে হতে পারে। কান পাঁকা বা কানের পর্দায় ছিদ্র থাকলে কানের শুনানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কানের ওয়াক্স বেশীমাত্রায় জমে গেলেও শুনানি কমতে পারে, যা বের করে দিলে শুনানি স্বাভাবিক হয়ে যায়।জেনেটিক বা জন্মগত ত্রুটি বা অসুখ – বিভিন্ন কারনে সারা বিশ্বে এটা এখন মহামারীর রুপ নিচ্ছে।
  • আঘাত ও অসুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – কানে ও মাথায় আঘাত এবং নির্দিষ্ট কিছু অষুধের পার্শ্বপ্রিক্রিয়ার কারনে শুনানি কমতে থাকে।
  • টিউমার – কান, ব্রেন ও আশেপাশের কিছু টিউমারের কারনে কান ও শ্রবণের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
  • সেন্ট্রাল অডিটরি প্রসেসিং ডিজওর্ডার – এতে কান ও কানের কার্যকারিতা ঠিক থাকে কিন্তু ব্রেন শব্দের তথ্যগুলো ঠিক মত পড়তে পারে না।
  • অডিটরি নিউরোপ্যাথি – কান থেকে ব্রেনে শব্দ পৌঁছে দেয়ার কাজে নিযুক্ত স্নায়ু ( ককলিয়ার নার্ভ) কার্যকারিতা হারালে।
  • অভিনয় – ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্য কেউ যদি কানে না শুনার অভিনয় করে।
  • সাধারণ কিছু রোগ – ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, কিছু অটোইম্মিউন রোগের কারণে শুনানি কমার হার বেশী দেখা যায়।

তাই আসুন কান ও শুনানির যত্নে আমরা সকলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। নিজেরা সচেতন হই এবং অন্যদের সচেতন করি। পরবার ও সমাজে কেউ কান বা শুনানির সমস্যায় আক্রান্ত হলে আমরা তাকে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করি।

ডাঃ আলমগীর মোঃ সোয়েব
এমবিবিএস, বিসিএস(স্বাস্থ্য), ডিএলও(বি এস এম এম ইউ)
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
কনসালটেন্ট (ইএনটি)
নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও হেড নেক সার্জন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *